কাল রাতে কাল্পনিক প্ল্যানচেটে উত্তম কুমার কে ডাকলাম। তারপরের বার্তালাপ-
উত্তম- কি ব্যপার বলতো তো? ডাকলি কেন? জানিস তো Lockdown এ আছি, যা বলার তাড়াতাড়ি বল।
আমি- গুরু!! গুরু!! আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা আপনি আমার সামনে!! মহানায়ক!!
উত্তম- রাখ তো ওসব নাটক, ওসব মহানায়ক টায়ক বলে কিছু হয় না এখন, এখন আমি একটা লেপ্টে যাওয়া বাঙালী সেন্টিমেন্ট ছাড়া কিসসু না। কিছু বুড়ো চায়ের দোকানে বখাটে ছোকরাদের প্রেম-ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে আমার কথা বলবে, আর আমার জন্মদিনে, মৃত্যুদিনে কাউতালি হবে। ব্যাস এইটুকু, এর বাইরে বাকি যা আছে তা চাঁদের পাহাড় আমি আর কি বল। যাক বাদ দে,কতক্ষন জ্বালাবি সেটা বল।
আমি - নানা, আপনি বিব্রত বোধ করলে চলে যেতে পারেন। তবে একবার যখন পেয়েছি আপনাকে, কিছুক্ষন তো কথা বলবো,।
উত্তম- যা জিগ্যেস করার জলদি কর, কুইক! মাস্ক ছাড়া এসছি ধরতে পারলে আখরোট ভেঙে, লাল করে দিয়ে ছাড়বে। ওদিকে আবার বেনু আর গৌরী দুজনেই একা আছে।
আমি- এখনকার ছবি দেখেন? ভালোলাগে?
উত্তম- রাবিশ!! বেনুর সাথে লাস্ট "চাঁদের পাহাড়" দেখেছিলাম, বিভুতি বাবুর লেখাটাকে নিয়ে চচ্চড়ি রেধেছে পরিচালক। আর ওই ছোকরা, তোমরা যাকে "মহানায়ক" বলো, নামটা মনে আসছেনা, হাহাহা! মহানায়কই বটে, আমাদের সময় জন্মালে ছোকরাকে নায়ক কাকে বলে বুঝিয়ে দিতাম। শালা ডায়লগ বলতে শুরু করলে মনে হয় উফ কখন ডায়লগ শেষ হবে, এতো বিশ্রী উচ্চারন!!
আমি- সে তো বটেই, তবে ভালো অভিনেতা কিন্তু এখোনো আছে।
উত্তম- বটে?
আমি- হ্যা,পরমব্রত,আবীর, শাশ্বত, অনির্বাণ, ঋত্বিক !!
উত্তম- ব্যাস?? ফুরিয়ে গেল?? হাহা! শোনো হে এমন কেউ কি আছে যাকে দেখতে মানুষ নাওয়া খাওয়া ছেড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা রোদ, বর্ষা উপেক্ষা করে হলের কাউন্টারে লাইন দেবে? এমন কেউ আছে যে সিনেমায় এন্ট্রি নিলে প্রথম তিনমিনিট হাততালি আর সিটিতে কিছু শোনা যাবে না? এমন কেউ কি আছে যে নায়িকা কে না ছুয়ে দর্শকদের খাড়া করে দিত? শোনো হে ছোকরা, এখন কোয়ালিটি নিশ্চয় আছে, ক্রেজ নেই। ওটা বঙ্গদেশে একজনেরই ছিলো।
আমি- হে হে, আপনি তো গুরুদেব। আপনার হেয়ার স্টাইল, সিগারেট মুখে নিয়ে কথা বলা, সিড়ি দিয়ে ওঠা, ফিরে তাকানো....
উত্তম - উফ,
থাম থাম!! তোরা শুধু ওগুলোই দেখলি?? অভিনয়?? তুমি আলেয়া দেখেছ? শুধু একটি রাত দেখেছ? সন্ন্যাসীরাজা,সাগরিকা,অ্যান্টনীফিরিঙ্গি দেখেছ?আরেকটা পিস দেখাও তো যে মানিকদার নায়ক করতে পারতো!! হু!! শুধু লুক দিয়ে সুপারস্টার হওয়া যায় হয়তো, কিন্তু আমার অভিনয় কোয়ালিটি যদি না থাকতো তাহলে টেসে যাওয়ার আটত্রিশ বছর পরেও চ্যানেলে আমার থোবড়া দেখে পাবলিক রিমোট নামিয়ে রাখতো না।
আমি- আচ্ছা গুরু, এখন তো আপনার অবসর। কিভাবে সময় কাটান?
উত্তম- কোথায় আর অবসর বাছা! ওপরে আমাদের একটা দল আছে। হেমন্ত বাবু আর মানিক দা সেই দলের নেতা। প্রতি মাসে পোগ্রাম হয়। আসর বসে। ঠিক যেমনটা আমার স্ত্রী ছবিতে দেখেছ। এই তো সেদিন ছবি দা মানে ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী দা আর অনিল চ্যাটার্জীর সাথে আসর বসালাম। আসরে বম্বের মীনাকুমারী দেবানন্দ রাজ কাপুররাও এসেছিল। বেশ আনন্দেই কাটে সময়। তবে একটাই দুঃখ।
আমি - কি
সেটা?
উত্তম - এখন আর সেই পাবলিক ফ্লেভারটা নেই। এখন আর রাস্তায় বেরোলে জ্যাম হয় না। মেয়েরা মুর্ছা যায় না। ভাবলে অবাক লাগে সেই দিনগুলো, নবীনা তে সপ্তপদীর প্রিমিয়ার, একবার জনসমক্ষে এসেছিলাম। পাবলিক আমার পাঞ্জাবি ছিড়ে দিয়েছিল, ভবানীপুরে টেনিস খেলে ক্লাব থেকে বেরোতেই মুহুর্তে দুশো লোক জড়ো হয়ে গেল। সেই গুরু গুরু ডাক!! এসব ভারী মিস করি। সেদিন মান্না বাবুর সাথেও এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল।
আমি - আমাদের কাছে আপনি একমাত্র নায়ক। দেবতুল্য নায়ক।
উত্তম- ছি ছি!! ওসব বলিস না। নায়ক মানেই দেবতুল্য মানুষ হয় না। মানিক দা এসব শুনলে রেগে যাবেন।
আমি- এখন যারা কাজ করছে তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
উত্তম- কি বলি বলোতো!! এদের দেখলে তো মনে হয় মায়ের পেট থেকেই সব জেনে বসে আছে। একটু নত হতে শিখুক। একটু কোয়ালিটির দিকে মন দিক। অভিনয় টা করার আগে চরিত্রের ভেতর ঢুকুক। মোদ্দা কথা, পাবলিক কে খুশি করতে গেলে পাবলিকের পালস বুঝতে হবে। সুইজারল্যান্ডে ধেই ধেই করে নেচে কি আর মহানায়ক হওয়া যায়? বাঙালী কে বাঙালীর মতো করে মুগ্ধ করতে হবে, যেটা আমি করেছিলাম। যেটা পুলু মানে আপনাদের সৌমিত্র এখোনো করছে। কিন্তু ছোকরা !এখন তো আমাকে যেতে হবে।
আমি- নিশ্চয়। তবে যাওয়ার আগে শেষ কিছু বলে যান।
উত্তম- ভালো থাকবেন সবাই। মনে রাখবেন একটা উত্তমকুমার তৈরী হতে চল্লিশ বছরের অধ্যাবসায় দরকার হয়। তাই আজও আমি এক এবং অদ্বিতীয় নায়ক। আসছি। বিদায়।
আমি- বলছি একটা Selfie কিমবা Autograph....... ঠিক আছে ঠিক আছে যান।
মিলিয়ে গেলেন উত্তম কুমার। অন্ধকার ঘরে একটা সংলাপ ভেসে আসছিলো। সন্ন্যাসী রাজার সংলাপ "তোমরা আমার জয়ধ্বনি দিচ্ছো,কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমাদের দেওয়ার মতো আজ আমার কাছেআর কিছু নেই"।
ConversionConversion EmoticonEmoticon